আন্তর্জাতিক ডেস্ক
জলবায়ুর প্রভাবে ব্রাজিলে এ বছর সয়াবিনের উৎপাদন কম হয়েছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করছে না চীন। তারা সয়াবিন নেবে আর্জেন্টিনা থেকে। এদিকে আর্জেন্টিনাও সয়াবিনের উৎপাদন সংকট কাটিয়ে চীনের বাজার ধরতে চায়। কারণ, চীনে বছরে সয়াবিনের চাহিদা রয়েছে প্রায় দুই কোটি টনের। আর তা ঘটলে অন্য কোনও দেশে সয়াবিন রফতানির সুযোগ নেই আর্জেন্টিনার। এমন পরিস্থিতির কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে সয়াবিনের দাম।
ওয়ার্ল্ড গ্রেইন ডটকম-এর খবরে জানা গেছে, এ বছর আর্জেন্টিনা প্রায় দেড় কোটি টন সয়াবিন রফতানি করবে চীনে।
যুক্তরাষ্ট্র সয়াবিন রফতানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে। যার কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি দামে সয়াবিন কিনতে আগ্রহ হারিয়েছেন চীনা আমদানিকারকরা। এ সুযোগই লুফে নিয়েছে আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো।
আর্জেন্টিনার কৃষি খাতের পরিচিত প্রতিষ্ঠান রোজারিও গ্রেইন এক্সচেঞ্জের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে আর্জেন্টিনা থেকে চীনের বাজারে ২০০৯-১০ মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ ১ কোটি ৩৩ লাখ টন সয়াবিন রফতানি হয়েছিল। এ বছর ১ কোটি ৪০ লাখ টন সয়াবিন রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে।
অবশ্য চাহিদা বাড়ায় সয়াবিন উৎপাদনেও জোর দিয়েছে আর্জেন্টিনা। এ কারণে চলতি বছর শেষে দেশটিতে ৫ কোটি ৫৫ লাখ টন সয়াবিন উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)।
জানা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার এখন সবচেয়ে চড়া। এক মাসের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বছর ব্যবধানে এ বৃদ্ধির হার ১২ দশমিক ২০ শতাংশ। এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কথা বলে পণ্যটির দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দিয়েছে ভোজ্যতেল আমদানিকারক সমিতি।
ভোজ্যতেল আমদানি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিল মালিকরা টনপ্রতি এক হাজার ডলারের কাছাকাছি মূল্যে সয়াবিন আমদানিতে এলসি খুলেছেন। এতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে খরচ প্রায় ১৩০ টাকা পড়বে। এ কারণেই দাম বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর বাজার মনিটরিংয়ে দেখা গেছে, গত এক মাসে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। বোতলজাত প্রতিলিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ৮০-৮৫ টাকা। আমদানিকারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিলিটার সয়াবিন তেলের দাম দাঁড়াবে ১৩০ টাকা। সঙ্গে পরিশোধন ব্যয়, মুনাফা ও বিভিন্ন প্রকার শুল্ক যুক্ত করে খুচরা পর্যায়ে আরও ৫-১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে হবে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব জানিয়েছেন, আমদানিকারকদের মূল্য বাড়ানোর আবেদনের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে।
জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ভোজ্যতেলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে তিন স্তরে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আমদানিকারকরা দাবি করছেন, তিন স্তরে ভ্যাট আরোপ করাতেও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেলের দর ছিল ৭০৭ মার্কিন ডলার, যা নভেম্বরে উঠেছিল ৯৭৪ ডলারে। এখন তা এক হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ১৯ থেকে ২০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত সরিষা, তিল, তিশি, সূর্যমুখী থেকে পাওয়া যায় ৪-৫ লাখ টন। বছরে আমদানি করতে হয় ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন।
অয়েল ওয়ার্ল্ডের তথ্যের সূত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে ২০১৯ সালে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার টন এবং ২০১৮ সালে ১৭ লাখ ২০ হাজার টন। ২০১৯ সালে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৯০ হাজার টন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউতে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর আগের বছর ব্যয় হয়েছিল ১৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। তাই আমদানিতে কর-কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা উচিত। তা না হলে ভোক্তার কষ্ট বাড়বে। ভোজ্যতেল আমদানিতে তিন স্তরের ভ্যাট পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে তীর ব্যান্ডের সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা জানিয়েছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম টালমাটাল অবস্থায় আছে। পণ্যটি যেহেতু শতভাগ আমদানিনির্ভর, তাই এর দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেই সম্পর্কিত। এখানে আমাদের কিছুই করার থাকে না।’
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে। আমরা আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলছি।’
খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি দরে। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। বিভিন্ন ব্রান্ডের পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৪০ টাকায়।