চলনবিলের গয়না নৌকা আজ কেবলই স্মৃতি

351

এ এইচ খোকন চলনবিল প্রতিনিধিঃ *গুণ টানা মাঝি, নৌকার দিশা দিতে টেনে গেছে তার নাও।
মাঝির ঘাড়ের ঐ যে কালসিটে কালো দাগ,
আজও ইতিহাসের স্বাক্ষী।
নির্বাক যন্ত্রের মতো এগিয়ে গেছে সে,
খাড়া ঐ বিস্তৃত নদীর কিনার দিয়ে।
ঝড় আসে, বৃষ্টি আসে, মেঘ গর্জায় জোরেশোরে,
তবু তাঁর এ হাঁটা থামে না।
ভরা পূর্ণিমার চাঁদের সাথে হাঁটে সে,
নিশীথ রাতে চাঁদ বিহীন ঘোর অন্ধকারে,
নদীর পানির ছলাৎ শব্দ ও তাকে বলে দেয় এই পথে চলতে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া পণ্য পরিবহণ ও জেলেদের মাছ ধরার কাজে নৌকার ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্ষাকালে নৌকা প্রচুর ব্যবহার হয়। নৌকার চালককে বলা হয় মাঝি। নৌকার বিভিন্ন অংশ হলো-খোল, পাটা, ছই বা ছাউনী, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তল, নোঙর, গলুই, বৈঠা, লগি ও গুণ। মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকা আকারে ছোট৷ আবার মানুষ ও পণ্য পরিবহণের নৌকা আকারে মাঝারী৷ এক সময় চলনবিল এলাকায় দৈর্ঘ্যে লম্বা ও সরু মাঝারি ধরনের গয়না নৌকার দেখা মিলতো৷ মূলত যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের কাজেই এ নৌকা ব্যবহার করা হতো। একসাথে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এই নৌকাটির। বর্তমানে গয়না নৌকা বিলুপ্তি হয়ে গেছে।
বেশীদিন আগের কথা নয়৷ আশির দশকের গোড়ার দিকেও চলনবিল এলাকায় দেখা যেত গয়না নৌকা৷ ঢোলকের ঢুং ঢাং শব্দ জানান দিতো গয়না নৌকার আগমনী বার্তা৷
মাঝিরা নৌকা চালাতেন বাতাসে ভর করে পাল তুলে। বাতাস অনুকূল না হলে দাঁড় টেনে গুন টেনে চলতে হতো গন্তব্যে। লুঙ্গি “কাঁছা” মেরে সীমাহীন কষ্টে গুণ টেনে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যেতে হত। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, পলি, কাঁদা উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গুন টানতে হতো জীবন জীবিকার তাগিদে। দৃশ্যটি এককালের বাংলার পল্লী প্রকৃতির রূপের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল অনন্তকাল ধরে। দূর গন্তব্যে যেতে হলে মাঝিরা অনুকূল বাতাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতো যাতে পাল তুলে সহজেই কম সময়ে যাওয়া যায় গন্তব্যে।
সিংড়ার কলম গ্রামের হাজী কবির হোসেন মাষ্টার বলেন, আগে চলনবিল এলাকায় আত্রাই, বড়াল, নন্দকূজা, গুমানী নদীতে কত রকম নৌকা চলতো নাইওরি নৌকা, পাল তোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, পানসি খেয়া নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, বাইচের নৌকা ও গয়না নৌকা৷ ছোট আকৃতির কিছু নৌকা টিকে থাকলেও কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে এই এলাকার জনপ্রিয় গয়না নৌকা৷

চলনবিল এলাকার চাঁচকৈর নতুন পাড়ার মহিউদ্দিন মাঝি জানান, বর্তমানে চলনবিল এলাকায় গয়না নৌকা শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। বেশির ভাগ নৌকাতে ইঞ্জিন সংযোজন করায় নদীতে নৌকা চলে দ্রুত গতিতে। ইঞ্জিনের ভট ভট বিকট শব্দ আর কালো ধোঁয়ায় পল্লী প্রকৃতির দৃশ্য আজ বিষিয়ে উঠেছে৷