বগুড়ার শাজাহানপুরে অবৈধ ৩১টি ইট ভাটা থেকে কোটি টাকা রাজস্ব নেয় সরকার

172

বিশেষ প্রতিনিধি, বগুড়াঃ সরকারের অনুমোদন নেই। নেই পরিবেশ সনদ। তবুও বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলায় ৩৫টি অবৈধ ভাটায় দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে ইট। নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের অনুমোদন নিয়ে ইট ভাটায় আগুন দিতে হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে অবৈধ এসব ইট ভাটা গুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নিচ্ছেনা প্রশাসন।

উল্টো অবৈধ ৩১টি ইট ভাটা থেকে ১কোটি ৩৯লক্ষ ৫০হাজার টাকা রাজস্ব নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সরকারের সংশ্লিস্ট দপ্তরের বিরুদ্ধে।

সবখানে ম্যানেজ করেই চলছে বলে জানিয়েছেন ইট ভাটার অনেক মালিক।

ভ্রাম্যমান আদালতের কারণে এই ব্যাবসায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বড় বাধা বলে মনে করছেন উপজেলার অনেক মাটি ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং ধুলোয় প্রায় বাড়িতে শ্বাষ কস্টের রোগী বলে জানিয়েছেন ইট ভাটা সংলঘ্ন গ্রাম গুলোর বাসিন্দারা।

সরেজমিনে স্থানীয়রা বলেন, উপজেলার খোট্রাপাড়া ইউনিয়নের দুবলাগাড়ি হাট, দুবলাগাড়ি মসজীদ ও ইয়াতিম খানা, দুবলাগাড়ি কলেজ, দুবলাগাড়ি মহিলা কলেজ, দুরুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ২টি, খলিশাকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, খলিশাকান্দি সরকারী বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘাষিড়া দাখিল মাদরাসা, ঘাষিড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোস্তাইল মাদরাসা এবং জনাকীর্ণ গ্রাম ঘেঁষে এলাকার এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যেই ৭টি ভাটায় দেদারছে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

এই ইউনিয়নের খোট্রাপাড়া মাদরাসার এক কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে উঠেছে ৬টি ইট ভাটা। আড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া মাদরাসা এবং বামুনিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনেই রয়েছে পরপর ২টি ইট ভাটা।

অন্য ইট ভাটা গুলো মাঝিড়া ইউনিয়নের সুজাবাদ, মাদলা ইউনিয়নের কাজিপাড়া এবং বেজোড়া এলাকার ৩বর্গকিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।

সুজাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেতগাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুজাবাদ মাদরাসা, মাদলা চাঁচাইতারা যুক্ত উচ্চবিদ্যালয়, বেজোড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেই ইট ভাটা গুলোতে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

ইট ভাটা গুলো তৈরি হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ার অনেক পরে। প্রত্যেক ইট ভাটা নির্মিত হয়েছে এলজিইডি সড়কের ধারে।

উপজেলার খোট্রাপাড়া ইউনিয়নের একজন ইট ভাটা এবং মাটি ব্যবসায়ী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, উপজেলায় কমপক্ষে ৬২টি ইট ভাটা ছিলো। ২০১৮ এবং ২০১৯সালে প্রায় ২৭টি ইট ভাটা স্বউদ্যোগে ভেঙে নেন মালিকরা। বর্তমানে কমপক্ষে ৩৫টি ইট ভাটা চালু আছে। গড়ে প্রতিটা ইট ভাটা ৫০লক্ষ ইট উৎপাদন করে। ইট ভাটা গুলোর কোনটিরই পরিবেশের ছারপত্র নাই।
সব কিছু ঠিক থাকলে জেলা প্রশাসক ইট ভাটার লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। এরপর প্রতি বছর সেটি নবায়ন করতে হয়। গত বেশ কয়েক বছর হলো ইট ভাটার কোন লাইসেন্স জেলা প্রশাসক নবায়ন করেন নি । উপজেলার প্রত্যেক ইট ভাটা এখন অবৈধ। সবখানে ম্যানেজ করেই ইট ভাটা চালাতে হচ্ছে।

আরেক ইট ভাটার মালিক বলেন, ইট ভাটা অবৈধ হলেও সরকার ঠিকই রাজস্ব নিচ্ছেন। প্রতিটা ইট ভাটার জন্য কিস্তিতে সারে ৪লক্ষ টাকা নিচ্ছেন বগুড়া কাস্টমস, এক্সাইস ও ভ্যাট অফিস। বর্তমানে প্রথম কিস্তি ১লক্ষ ৮০হাজার, ২য় কিস্তিতে ১লক্ষ ৮০হাজার এবং শেষ কিস্তিতে ৯০হাজার টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে ।

সুজাবাদ এলাকার এক ইট ভাটা মালিক বলেন, ইট ভাটা চালানোর জন্য প্রচুর মাটি প্রয়োজন। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের আবাদি জমি খনন করে এই চাহিদা পূরণ হয়। বর্তমানে ভ্রাম্যমান আদালতের কারণে এই ব্যাবসায় বড় “আতঙ্ক” শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আহমেদ। তার কারণে এই ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। তাকে বদলির জন্য ব্যাসায়ী এবং মালিক পক্ষ বৈঠক করে উপর মহলে তদ্বির করা হচ্ছে। আমরা সু-সময়ের(উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বদলি) জন্য অপেক্ষা করছি।

তার(উপজেলা নির্বাহী অফিসার) ভয়ে কাহালু, গাবতলি, ধুনট এবং সদর উপজেলা থেকে মাটি এনে ইট বানাচ্ছেন কোন কোন ইট ভাটার মালিক। সুজাবাদ দহপাড়া এলাকার এক ভাটা মালিক বলেন, ইট ভাটা এবং মাটি ব্যবসায় অন্য কোন জেলা এবং বগুড়ার অন্য কোন উপজেলাতে এই সমস্যা নেই। শুধু শাজাহানপুর উপজেলাতেই প্রশাসনের যত ঝামেলা। সবখানে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেই আমরা ভাটা চালাই।

সরকার চাইলেই ইট ভাটা গুলো বন্ধ করতে পারবেনা। এই ব্যবসায় জড়িত প্রায় সবাই ক্ষমতা ধর। সরকারের নিয়ম মেনে ইট ভাটা চালানো সম্ভব না। প্রতি এক বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই স্কুল আছে। এলজিইডি রাস্তাও আছে।

দুরুলিয়া খাঁপাড়া গ্রামের মোটর সাইকেল মেকার শাহ আলম(৫৫) বলেন, ইট ভাটা হামাকরে জন্যে অভিশাপ বারে। ইট ভাটার ধুঁয়োয় হামাকরে গেরামত ঘরে ঘরে শ্বাষ কস্টের রোগী। হামরা নিঃশ্বাষ লিবার পারিন্য। কাপড় শুকাবার পারিন্য। খাবার বসল্যে পিলটত ধুল্য পড়ে। হামাকরে কতা কেউ শোনেনা বারে। ভাটা বন্ধে বছর খানেক আগে হামরা মানব বন্ধন করচনো। গাঁওত থ্যাক্যা ট্যকা তুল্যা হামরা হাই কোটত গ্যাচনো। ভাটার মালিকরা এক হয়্যা হামাকরে ছোল পোলের নামে মামলা দিচিলো। সগলি ওগরে দিকি। হামরা কুন্টি যামো।

একই গ্রামের মতিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, পাঁচটা পড়াইমারি স্কুল, কতগুলান মসজীদ, মাদরাসা, হাইস্কুল, দুডা কলেজও এটিই বারে। গাঁওত হাজারো মানুষ। তারি মদ্দে এত গুলান ভাটা হলি মানুষ বাঁচে কিঙ্কা কোর্য। ভাটাত্থ্যাকা সরকার যি টাকা পায়। হামরা গাঁওত থ্যাকা সেই ট্যকা তুল্যা দেমো। তাও হামাকরে বাঁচাও বারে।

মজনু মিয়া নামের আরেক জন বলেন, ই সমস্যা কলে হামাকরে এক গাঁওত লয়। দুরুলিয়া, খলিশাকান্দি, ঘাষিড়া, জোঁকা, সুজাবাদ, মাদলা, কাজিপাড়া, জালশুকা সুদ্দা আরো গাঁয়ের এক লক্ষের বেশি মানষের কলে এই সমস্যা। ভাটার টেরাকের চাকার সাতে পাকা রাস্তা শ্যাষ। যেটি সেটি পুকুর হওয়াত রাস্তা ভাঙ্য পুকুরত গ্যাচে। হামাকরে বাঁচাও বারে। হামরা এনা লিশ্বাষ লেই বারে।
জানতে চাইলে শাজাহানপুর উপজেলা ইট প্রস্তুতকারি মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব তোফাজ্জল হোসেন খান সাহান মোবাইল ফোনে বলেন, ৬২টি ইট ভাটা ছিলো। ২০১৯সালের দিকে আমার সহ অন্যদের মিলিয়ে প্রায় ২২টি ইট ভাটা স্বউদ্যোগে ভাঙা হয়েছে। এরচেয়ে বেশি বলতে পারবো না।

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ক প্রভাষক আবু সাঈদ বলেন, একটা ইট ভাটা ওই এলাকার জন্য অভিশাপ। এটা জীব বৈচিত্রের জন্য হুমকি। ইতিমধ্যে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ইট ভাটার গ্রহন যোগ্য টেকসই বিকল্প সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে।

শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আহম্মেদ বলেন, সরকার চাইলে আমাকে যে কোন সময় বদলি করতেই পারে। আমার উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালনে পিছপা হবনা। ইট ভাটা বন্ধকরা আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়েনা। কোথাও মাটি কাটার সংবাদ পেলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানতে চাইলে বগুড়া কাস্টমস, এক্সাইস ও ভ্যাট অফিসের রাজস্ব কর্মকর্তা আ,ক,ম, বজলুর রশীদ বলেন, ইট ভাটা গুলোয় লাইসেন্স আছে বা নেই সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কারখানায় উৎপাদন এবং বিপনন হলেই রাজস্ব দিতে হবে। শাজাহানপুর উপজেলায় মোট ৩১টি ইট ভাটার প্রতিটি ৪লক্ষ ৫০হাজার টাকা রাজস্ব দেয়। এতে মোট রাজস্ব হয় ১কোটি ৩৯লক্ষ ৫০হাজার টাকা।

বগুড়া জেলা প্রশাসক মোঃ জিয়াউল হক মোবাইল ফোনে বলেন, অনুমোদন বিহিন ইট ভাটার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহনের সুযোগ আছে। তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নেবো।

তবে কতদিনের মধ্যে অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে তা নিশ্চিৎ করেন নি।