শাজাহানপুরে মাধ্যমিকের বিনামূল্যের বই কর্মচারীদের সাথে নিয়ে চুরি করলেন শিক্ষক

95

শাজাহানপুর প্রতিনিধিঃ নৈশ প্রহরী, পিওন সহ কর্মচারী দিয়ে রাতের আঁধারে বিপুল পরিমান সরকারি পাঠ্য পূস্তক চুরি করে বিক্রি করে দিলেন কয়েক শিক্ষক। জড়িত এই শিক্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নিপুন হাতে করা কাজ সম্পর্কে প্রথমে কেউ জানতেই পারেনি। শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের কারণে সম্প্রতি তা প্রকাশ হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে।

গেল এএসসি পরীক্ষার শেষের দিকে শেষ রাতে ভ্যান এবং পিকআপে বই গুলো পার করেন তাঁরা। বিক্রির সত্যতা নিশ্চিৎ করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, কর্মচারী এবং ক্রেতা মাঝিড়া স্ট্যান্ডের ভাঙরী(পুরাতন কাগজ, লোহা, প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসি) ব্যাবসায়ী। বইগুলোর কেজি দরে আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৮লক্ষ টাকা হবে বলে বলছেন শিক্ষকরা।

অজ্ঞাত কারণে চুরি হওয়া বই গুলো উদ্ধারে উল্লেখ যোগ্য ভূমিক নেয়নি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। এই ঘটনায় ১নভেম্বর প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেছে দপ্তরটি। অপরদিকে নোটিশ পাওয়ার পর ২নভেম্বর বই হারিয়েছে উল্লেখ করে শাজাহানপুর থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছেন প্রধান শিক্ষক।

এই ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃস্টি হয়েছে। চায়ের দোকান সহ লোক সমাগম হয় এমন স্থানে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে ঘটনাটি। তদন্ত করে দায়িদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন বিভিন্ন সংগঠন।
সরেজমিনে জানাযায়, শাজাহানপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের নিজস্ব গোডাউন নাই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য আসা পাঠ্য পূস্তক গুলো মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যলয়ের একটি বড় কক্ষে রাখা হত। সেখান থেকে বই গুলো বিভিন্ন মাধ্যমিক এবং সমমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হতো। বিতরণের পর বেঁচে যাওয়া বই গুলো ওই কক্ষে থাকতো। সবচেয়ে বেশি বই জমা হয় করোনা কালিন সময়ে। এই সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী না থাকায় বই বিতরণ হয় খুবই কম। ২০১৩সাল থেকে ২০২১সাল পর্যন্ত ওই কক্ষে বই জমা হচ্ছিল।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকারী শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ের বড় কক্ষটি পাঠ্য পূস্তকে ঠাসা ছিল। কক্ষের দৈর্ঘ্য ২৫ফিট এবং প্রস্থ্য ২০ফিট। সাল পুরাতন হলেও বই গুলো সব চকচকে নতুন। গত এসএসসি পরীক্ষার শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর কর্মচারীদের সাহায্যে বই গুলো চুরি করে বিক্রি করেন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম এবং হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম। প্রধান শিক্ষককে অবহিত না করে এই চুরি কোন অবস্থাতেই সম্ভব না।

তাঁরা বলেন, মোট ১২রাতে বিদ্যালয় থেকে বই গুলো চুরি করা হয়। রাত ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে বই গুলো বস্তায় ভরেন নৈশ প্রহরী বাচ্চু মিয়া, পিওন আব্দুস সামাদ, আরেক পিওন ফরহাদ আলী, মালি আব্দুল জুব্বার। রাত ৩টার দিকে ভ্যানে করে সেগুলো মাঝিড়া স্ট্যান্ডে ভাঙরি ব্যবসায়ী মঞ্জুরুলের কাছে পাঠান। সেখান থেকে পিকআপ এ করে অন্য জায়গায় চলে যায়। বাজারের নৈশ প্রহরীদের চোখের সামনে ঘটনা গুলো ঘটে। বিদ্যালয়ের লোকজন থাকায় কেউ বাধা দেন নি।

কয়েক শিক্ষক বলেন, বিষয়টি আমরা শুরু থেকে জানলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলিনাই। পরে শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের কারণে বিষয়টি বাহিরে জানাজানি হয়। পরে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। অপর দিকে বই চুরি হলেও প্রধান শিক্ষক থানায় হারানো জিডি করেন। এর সবই অপরাধীদের বাঁচানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত চুরি হওয়া বই উদ্ধার হয়নাই এবং জড়িত কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নাই। আনার জন্য কেউ চেস্টাও করে নাই।

জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের পিওন ফরহাদ আলী সাংবাদিকদের জানান, বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম আমাকে বই গুলো বস্তায় করে বিদ্যালয়ের বাহিরে পাঠানোর জন্য বলেন। এই কাজের জন্য প্রতিরাতে ৫শত টাকা করে পারিশ্রমিক দিয়েছেন। প্রশাসন সহ সবাইকে ম্যানেজ করে কাজটি করা হচ্ছে। ভয়ের কিছু নাই বলেও আমাকে আশ্বস্ত করেন।

বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী আব্দুস সামাদ সাংবাদিকদের জানান, বই গুলো আমরা বস্তা করেছি। ৩০থেকে ৪০বস্তা হবে। বই বিক্রির বিষয়ে আমার কিছু জানা নাই। যা করার স্যারেরা করেছে।

সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম এবং সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের জানান, বই চুরির ঘটনা আমাদের জানা নাই।
দপ্তরী বাবলু মিয়া জানান, বই চুরির ঘটনায় আমি কোন ভাবেই জড়িত না। মূলত সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম এবং সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম মিলে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বই বস্তায় ভর্তি করা, ওজন করা, ভ্যান এবং পিকআপ এ তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সহযোগীতা নিয়েছেন।

জানতে চাইলে মাঝিড়া এলাকায় ভাঙরী ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল হোসেন এবং রানা সাংবাদিকদের জানান, মাঝিড়া স্কুলের বই আমার এখানে মেপেছে কিন্তু আমি সেগুলো কিনি নাই। এক সকালে ৮থেকে ৯টি পিকআপে বস্তায় ভরা বই গুলো নিয়ে গেছে। কোথায় নিয়ে গেছে তা আমার জানা নাই। মাপার সময় বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম সহ স্টাফরা উপস্থিত ছিলেন।
 জানতে চাইলে শাজাহানপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ মাহবুবুল হোসেন জানান, আমাদের গোডাউন না থাকায় পাঠ্য পূস্তক গুলো মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে রাখা হত। কি পরিমান বই ছিল তার সঠিক হিসেব আমাদের কাছে নাই। আমি নতুন এসে সেই হিসেব পাইনি। তবে ২০১৬সাল থেকে ২০১৮সাল পর্যন্ত বই ওই স্কুলে রাখা ছিলো। ২০১৯সাল থেকে আড়িয়া রহিমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের কক্ষে বই গুলো রাখা হচ্ছে। বই হারানোর ঘটনায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে ১নভেম্বর প্রধান শিক্ষককে ৭কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। জবাব পাওয়ার পরে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আড়িয়া রহিমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মোনায়েম জানান, ২০২১সাল থেকে মাধ্যমিকের বই আমার স্কুলে রাখা হচ্ছে। এর আগে বই রাখা হয় নাই। সেগুলো মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়েই রাখা হতো। ২০১৮সালের পর থেকে আমার এখানে বই রাখা হয় এটা সঠিক নয়।

মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মির্জা দিলরুবা লাকী সাংবাদিকদের জানান, বই বিক্রি কিছু না। স্কুলে কিছু পুরাতন কাগজ পত্র ছিল। তারমধ্যে ২০১৫ এবং ২০১৬সালের পুরাতন কিছু বই ছিলো। এসএসসি পরীক্ষার মধ্যে আমরা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে জানাই যে আমাদের কক্ষটি লাগবে। তারা আমাদের স্থানান্তর করতে বলে। আমরা সেগুলো স্থানান্তর করি এবং ব্যবহার অযোগ্য কিছু বই বিক্রি করা হয়েছে।

দূর্ণীতি দমন প্রতিরোধ শাজাহানপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি নিরঞ্জন মোহন শাহা জানান, জানতে পেরেছি মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাতের অন্ধকারে পাঠ্য পূস্তক গুলো চুরি করে বিক্রি করা হয়েছে। এর একটি বিচার হওয়া উচিৎ। সরকারি বই বিক্রি করার অধিকার কারো নাই। জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি রেখেছেন তিনি।

শাজাহানপুর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বই হারিয়েছে উল্লেখ করে মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মির্জা দিলরুবা লাকী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছেন।
 জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার(ডিইও) মোঃ হযরত আলী জানান, বিষয়টি জানার পর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তদন্ত করে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে আমি নিজে আইনগত পদক্ষেপ নিব।

জানতে চাইলে বগুড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা ও আইসিটি নিলুফা ইয়াছমিন বিষয়টি নিয়ে শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আহমেদ জানান, বিষয়টি জানার পরে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এবং ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি।

জানতে চাইলে দূর্ণীতি দমন কমিশন বগুড়া কর্যালয়ের উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামান জানান, কেউ বাদী হয়ে অথবা বেনামে আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। ঘটনাটি পত্রিকায় আসলেও আমরা সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারব।