প্রচণ্ড দাবদাহ ও সেচ সংকটে বগুড়ায় বোরো আবাদ হুমকির মুখে

72
প্রচণ্ড দাবদাহ আর বিদ্যুতের অভাবে সেচ সংকটে বগুড়ায় বোরো ধানের আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। এ জেলায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করায় ধানের পরাগায়ন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে গাছে ধান জন্মাতেও সমস্যা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক গাছে পচন ধরতে শুরু করেছে। কোন কোন স্থানে আবার পোকা-মাড়কের উপদ্রবও বেড়েছে। কৃষকদের আশঙ্কা যদি ২/৩ দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত কিংবা বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তাহলে ধানের ফলন বিপর্যয় হতে পারে।
তবে স্থানীয় বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ফলে এখন সেচ নিয়ে আর কোন সংকট থাকবে না। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দাবদাহ মোকাবেলায় তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। ফলন বিপর্যয়ের কোন শঙ্কা নেই।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলায় এবার ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বোরো ধানের ক্ষেত্রে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই পরাগায়ন শুরু হয়। এ সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পরাগায়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধানও চিটা হয়ে যায়। তবে কোন কারণে তাপমাত্রা বেশি হলেও নিচে গাছের গোড়ায় ২ থেকে আড়াই ইঞ্চি পানি সংরক্ষণ করলে ক্ষতি এড়ানো যায়।
বগুড়ায় আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহ আলম জানিয়েছেন, ১০ এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির নিচে ছিল। তবে ১১ এপ্রিল ৩৫ ডিগ্রি অতিক্রম করে এবং তার পর থেকে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ১৩ এপ্রিল জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৭ দশমকি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বশেষ ১৮ এপ্রিল বেলা ৩টায় বগুড়ায় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি হঠাৎ করে বিদ্যুতেরও ঘন ঘন লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলেই লোড শেডিং বেশি। কোন কোন গ্রামে ২৪ ঘন্টায় ১৪/১৫ বার বিদ্যুৎ থাকে না। লোডশেডিং বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর পক্ষ থেকে ১৮ এপ্রিল স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় যে, রামপাল ৫০০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আশুগঞ্জ ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও চট্টগ্রাম (রাউজান) ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকা এবং হাটহাজারি ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের পি,টি বিস্ফোরণের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় সারাদেশ লোড শেডিং হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে সহসাই এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া জেলায় বিদ্যুতের গড় চাহিদা ৩৭৩ মেগাওয়াট। কিন্তু ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহ পাওয়া গেছে ২৫৬ মেগাওয়াট করে। শহর কেন্দ্রিক নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) চাহিদা ১৫০ মেগাওয়াটের বিপরীতে মিলেছে ১০০ মেগাওয়াট আর গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত পল্লী বিদুৎ সমিতির (দু’টি সমিতি মিলে) চাহিদা ২২৩ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া গেছে ১৫৬ মেগাওয়াট। বোরো আবাদের জমি সেচের জন্য মোট যে ২৬৮৩টি গভীর নলকূপ রয়েছে তার ৯৮ দশমিক ৪৭ শতাংশই বিদ্যুৎ চালিত। বিদ্যুতের লোড শেডিংয়ের কারণে জমি সেচ বিঘিœত হচ্ছে। বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন, বিদ্যুতের সরবরাহ ঘন্টায় ঘন্টায় কম-বেশি হচ্ছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টায় ১১৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ৮১ মেগাওয়াট পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু রাত ৯টায় আবার চাহিদার পুরোটা সরবরাহ পাওয়া গেছে। তবে পল্লী বিদ্যু সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা মনোয়ারুল ইসলাম ফিরোজী জানান, প্রতিদিন ১০৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে গড়ে ২৫ শতাংশ শেডিং করতে হচ্ছে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার খিদিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবু সাঈদ সুজা জানান, চারদিন আগে থেকে লোড শেডিং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২৪ ঘন্টায় গড়ে দুই ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায়নি। যে কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ২টি গভীর নলকূপের আওতায় থাকা সাড়ে ৩০০ বিঘা জমিতে চাহিদা অনুযায়ী সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওই গ্রামের কৃষক সেকেন্দার আলী সরদার তার পানি শূন্য জমি দেখিয়ে বলেন, ‘এখন গামোরের (গাছে ধান জন্মানোর) সময়। এই সময়ে বৃষ্টির খুব দরকার। বৃষ্টি হলে সূর্যের তাপ কমে আর গাছের গোড়ায় পানিও থাকে। তাতে ধানের ফলনও ভাল হয়। কিন্তু গত পনের দিনে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। যে কারণে সূর্যের তাপ যিঙ্কা (যেমন) বাড়িছে (বেড়েছে) সিঙ্কা (তেমনই) কারেন্টের (বিদ্যুৎ) অভাবে জুমি (জমি) সিচা (পানি সেচ) দেওয়াও যাওছে না (যাচ্ছে না)। পানির অভাবে জুমিগুলা খট খট (শুষ্ক হয়ে যাওয়া) করিচ্চে। যদি ২/৪ দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হয় অথবা পানি সিচা দেওয়া না যায় তাহলে গামোর পচে যাবে। ধান আর পামো না (পাব না)।’ তিনি এবার দুই বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। পাশের শিবগঞ্জ উপজেলার মোড়াইল গ্রামের কৃষক গোলাপ প্রামাণিকও একই কথা বলেছেন। একই উপজেলার পীরব গ্রামের কৃষক ফকির সোহেল বলেন, নিচু জমিতে কিছু পানি ধরে গেলেও উঁচু জমিতে পানি থাকছেই না। এতে কিছু কিছু ধান গাছে পচন দেখা দিয়েছে এবং কোন কোন গাছে মাজরা ও কারেন্ট পোকা লেগেছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার পীরব ইউনিয়ন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা খুরশিদা বেগম জানান, সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত পরাগায়নের সময়। এই সময়ের মধ্যে তাপমাতা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তা ধান গাছের জন্য ক্ষতিকর। বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবুর রহমান জানিয়েছেন, প্রচÐ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অতিক্রম করলে ধান গাছ থেকে পানি বের হয়ে যায়। এতে যাতে ধান গাছ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ধান গাছের গোড়ায় দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বিদ্যুতের লোড শেডিংও কমে এসেছে এবং খুব শিগগির বৃষ্টিরও সম্ভাবনা রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও ধান গাছের কোন ক্ষয়ক্ষতির কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।’
দুপচাঁচিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপ-মহাব্যবস্থাপক গোলাম রব্বানী জানিয়েছেন, ওই উপজেলা এলাকায় তাদের চাহিদা ১২ মেগাওয়াটের বিপরীতে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ মেগাওয়াট করে সরবরাহ পেয়েছেন। তবে তিনি বলেন, ‘আজ (১৮ এপ্রিল) সকাল ৬টা থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। আশাকরি আর লোড শেডিং করতে হবে না।’
বগুড়ায় নেসকোর তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী হাসিবুর রহমান জানান, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সমস্যা থাকলেও ১৮ এপ্রিল সকাল ৯টার পর থেকে জেলায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই সরবরাহ কতক্ষণ স্বাভাবিক থাকবে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন নি। সূত্র পুন্ড্রকথা