উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী দুপচাঁচিয়া ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটের সৃষ্টি কিভাবে

63

উজ্জ্বল চক্রবর্ত্তী শিশির দুপচাঁচিয়া(বগুড়া) থেকে ঃ
সভ্যতার আদি থেকে মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির অনুযোগ হয়ে আছে ধাপ হাট। ঠিক কবে থেকে এই ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটের সৃষ্টি তা জানা না থাকেলও জনশ্রæতি আছে যে, পুন্ড্র রাজ্যের মহান সাধক পুরুষ হযরত শাহ্ সুলতান বলখী মাহী সওয়ার এক সময়ে অল্প কিছু দিনের জন্যে উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া থানার ধাপ নামক স্থানে এসে আবস্থান নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই স্থানে সুলতান মাহী সওয়ার ‘ধাপের দরগা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আরও পরে স্থানটির নাম হয় ‘ধাপ সুলতান’। কথিত আছে এখানে ঢিবি বা ধাপের উপর হযরত শাহ্ সুলতান বলখী এর আস্থানা ছিল এই আস্থানাকে ঘিরেই উত্তর বঙ্গের শতাব্দী প্রাচীন এই হাটের সৃষ্টি হয়।
উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার উত্তরে ‘ধাপ সুলতানগঞ্জ’ হাটটির অবস্থান। বর্তমানে এটি দুপচাঁচিয়া পৌরসভাধীন ধাপ মৌজার অর্ন্তগত হাটটির আয়তন প্রায় ১৩.৫৫ একর । বগুড়া- নওগাঁ মহাসড়কের উত্তর পার্শ্বে নাগর নদের ধারে হাটটির আবস্থান। হাটটি বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পার্শ্বে অবস্থিত হওয়ায় যোগাযোগের েেত্র মানুষ বেশ সুবিধা পেয়ে থাকেন। দুপচাঁচিয়া থানা বাসষ্ট্যান্ড ও মেইল বাসষ্ট্যান্ড থেকে দুটি পৃথক রাস্তা দিয়ে হাটে চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। দুপচাঁচিয়া-আক্কেলপুর রাস্তা থেকেও একটি সরু রাস্তা হাট পর্যন্ত গেছে। তেলাল ও শিবগঞ্জ উপজেলা থেকেও এই হাটে আসার রাস্তা রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী ধাপসুলতানগঞ্জ হাটটির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিটি দ্রব্য ও পণ্যের কেনা-বেচাঁর জন্য পৃথক পৃথক জায়গা(পট্টি)রয়েছে।যেমন-গরু,ধান,মাছ,মাংস(গোশত),তরকারি,কাপড় হাটি ইত্যাদি। ধাপহাটে আসা বিভিন্ন পণ্যের অধিকাংশই দুপচাঁচিয়া ও এর আশেপাশের আঞ্চল থেকে উৎপাদিত। এছাড়াও বাহির থেকেও কিছু পণ্য সামগ্রী আমদানী করা হয়। এই হাটে সুঁচ থেকে সাইকেল এবং গামছা থেকে জাল সবকিছুই বিক্রি হয়।এখানে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত ধান, গম, সরিষা সহ বিভিন্ন মৌসুমের তরিতরকারী, মসলা, ডাল, শস্য, গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালিন শাক-সবজি, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপী, খুরমা সহ হরেক রকমের মিষ্টি, পিঠা, দই, দূধ, বিশেষ ভাবে তৈরী ছিন্নী, মুড়ি- মুড়কি, চিড়া,কাঠেরৈ তৈরী জিনিস, তালের তীর, কূলা, চালুন, খলসানি, দা , বটি, কোদাল সহ বিভিন্ন কৃষি কাজের জিনিস পাওয়া যায়। এছাড়াও মাটির তৈরী জিনিস হাড়ি, পাতিল, হাঁস-মুরগী, কবুতরের, কোয়েল পাখি, বিভিন্ন ধরনের মাছ, মাংস, মসলা, শস্যের বীজ ইত্যাদি বিক্রি হয়। এছাড়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া বিক্রি হয়। এক সময় বড় বড় কাছিমও (কচ্ছপ) বিক্রি হতো। স্থানীয় কিছু কবিরাজ (হকার) সম্প্রদায় বিভিন্ন ঔষধি গাছ-গাছড়া ও জোঁকের তেল বিক্রি হয়। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড তাপদাহে হাটের বিক্রেতাকে কান্তি দূর করতে ঘৃতকুমারী সমৃদ্ধ শরবত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে দেখা যায়। শীতের সময় খেজুর রস,লালী গুড় ও পাটালি গুড় কিনতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন শ্রেনীর হকার সম্প্রদায় তাদের পণ্য বিক্রির জন্য নানা রকম সংগীত ও বাদ্য বাজিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন।স্বল্প মূলধন,অল্প শিা,ভারী বোঝা আর কুশলী কন্ঠস্বর নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফেরিওয়ালারাও নিজের জীবিকার সন্ধানে হাট করতে আসে। হাটে আসা ুধার্ত লোকজনের ুধা নিবারনের জন্য বেশ কিছু হোটেলও আছে। এ হাটকে কেন্দ্র করে এক সময় মেলা বসতো যা ‘ধাপের মেলা’ নামে পরিচিত ছিল। লোকজ সংস্কৃতির সকল কিছুই যেমন-সার্কাস,মাটির তৈরী বিভিন্ন জিনিস,খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি দেখতে এবং কিনতে পাওয়া যেত।
ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঢিবির উপর একটি মাজার, মাজার সংলগ্ন ঈদগাহ্, একটি মাদ্রসা, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি সরকারী গোডাউন, হাট পরিচালনার জন্য একটি কাছারী ঘর (অফিস ক) এবং প্রায় বিংশ শতাব্দী প্রাচীন কয়েকটি কড়ই ও পাকুর গাছ কালের সাী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় লোকজনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ঢিবির উপর কয়েক খন্ড কালো রং – এর বড় বড় পাথর ছিল যা আজ আর চোখে পড়ে না।
ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। রিক্সা চালক, ভ্যান চালক, দিন মজুর থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও সুবিধা ভোগ করে থাকেন। প্রতি বছর হাট থেকে কয়েক কোটি টাকার উপর রাজস্ব আদায় হয়। যা দ্বারা পৌরসভার সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। অনেক ুদ্র ব্যবসায়ীরা সপ্তাহে দুই দিন হাট করে জীবিকা নির্বাহ করে। হাটের বাড়তি পণ্য বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যস্বত্ব ভোগী হাট থেকে ক্রয় করে শহরে বিক্রি করে। মোট কথা হাটকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে।