এসপি মাহফুজ্জামান আশরাফ শিমুলের বাবাকে নিয়ে হাজারো অনুভুতি!

261

————————————–
হঠাৎ মধ্যরাতে আম্মার মোবাইল বেজে উঠলো।রাতে রিং বেজে উঠা আর তা যদি আম্মার হয় তাহলে খুব আতংক হয়ে পড়ি,
হ্যালো,শিমুল
হ্যা মা,কি হয়েছে…?
তোর বাবা, ঘুমাচ্ছে না,অস্থির হয়ে আছে
কেন?
“ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেছে আর বলছে,মলি(আমার আম্মার নাম।নাম ধরেই ডাকে আব্বা) আমাকে লুকিয়ে রাখো পুলিশ আমাকে ধরতে এসেছে।
“পুলিশ এসেছে,পুলিশ এসেছে বলে ভয়ে আতংকে চিৎকার করে ”
তোমার বাবা প্রায়ই এরকম ভয় পায়,আতংকগ্রস্থ হয়ে যায়।আমার ভয় লাগে তোমার বাবার এমন আচরণে।
বাবার কথাগুলো বলতেই, বললাম আব্বাকে মোবাইল দাও…..
হ্যালো, আব্বা
হ্যা,বাবা,কেমন আছো(কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট গলায়)
আমি, ভালো আছি আব্বা,তুমি পুলিশকে ভয় পাও কেন.??
কোন কথা বলেনা আব্বা।চুপচাপ মোবাইল ধরে শুধু হু হু শব্দ করে।
তোমার ছেলেইতো পুলিশ আব্বা।খুব জোর দিয়ে বললাম কথাগুলো।
ও পাশ থেকে আব্বা শুধু হ্যা হ্যা বলে যায়।

পরদিন আমি চলে আসি আব্বার কাছে।আব্বার কাছে গিয়ে বসে গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম,”পুলিশ এলে কোনই ভয় পাবে না আব্বা।তুমিতো সাহসী মানুষ আব্বা।এক ধমক দিবে।এতবড় সাহস তোমাকে ধরতে আসে।আমি “এসপি সাহেব”কে বলে দিবো”
হ্যা, বাবা,তুমি এসপি সাহেব বলে দিবা,আমাকে যেন ডিষ্টার্ব না করে।কাপতে কাপতে বলছে আমায়।
ঠিক আছে আব্বা, আমি আজই এসপি সাহেব কে বলে দিবো।তুমি ভয় পাবেনা।কিসের ভয় তোমার।তুমিইতো এসপির বাবা।এবার পুলিশ এলে বলবে, তোমার ছেলে পুলিশের এসপি।
কেউ তোমাকে নিয়ে যাবে না আব্বা।ওরাই ভয় পেয়ে যাবে…..
এভাবে কত কথা বলে স্বান্তনা দিতে থাকলাম।

রাজনৈতিক জীবনে পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে ফেরারী জীবন পার করেছে।পুলিশের ভয়ে কত জায়গায় লুকিয়ে থেকেছে,পালিয়ে বেড়িয়েছে।মিছিল মিটিং আর বক্তৃতা দিয়েই পালিয়ে গিয়েছে।কতবার যে পুলিশ এসেছে আমাদের বাড়িতে আব্বাকে গ্রেফতার করতে তার ইয়াত্তা নেই।
এখানে সেখানে কত জায়গায়,কত জনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে লুকিয়েছে।সর্বদাই গ্রেফতার আতংকে আন্দোলন মিছিল সংগ্রাম করেছে।

আজ বার্ধক্যর প্রান্তে হ্যালুসেনেশনে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে বার বার

এসপি সাহেব মিটিং এর পারমিশন দিলো না মলি(আমার আম্মা)।খুব আক্ষেপ করে আম্মাকে বলতে লাগলো দুপুরে ভাত খেতে খেতে।কত বোঝালাম উনাকে কিন্তু , বুঝে না।বলে আওয়ামীলীগের সভা হবেনা।
সভা,মিছিল করতে পারবেন না।করলে কিন্তু একশন নিবো…..
এসপি না বললেই হলো,সভা আওয়ামীলীগ করবেই।এসপি যা পারে করুক।আমরা ওসব হুমকিতে ভয় পাইনা।আওয়ামীলীগ এসপির চোখ রাঙ্গানিকে ভয় পায় না।

আব্বা ভয় পায় নি,
আব্বা ভয় পায় না সামান্যও….

বগুড়া জেলা আওয়ামীলীগের তেজী সিংহ নেতা।এসপি ডিসিকে এতটুকুও ভয় পায় না,ভয় পায়নিই কখনো।
বরং,
এসপি, ডিসিই ভয় পায় শহীদুল আলম দুদু কে….

এটাই চিরন্তন সত্য
এ গল্প নয়,এ সত্য কাহন…..

প্রচন্ড জেদী আর একরোখা তৎকালীন জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক জননেতা”দুদু”
দুদুকে না থামালে নয়।জেলা প্রশাসন,পুলিশ প্রশাসন আর কাউকে না হোক,এই দুদুকে থামাতেই হবে।
এমন গরম আর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয় যেন সরকারের গা জ্বলে যায়,আগুন ধরে যায়…
সত্যিই তাই,
আব্বার সাহসী বক্তৃতা, তেজদীপ্ত বক্তৃতা আজও অবিংসবাদিত যা দমাতে উঠে পড়ে লেগে যায়…

এসপি’র অফিসে আব্বার খোজ নিতে আম্মা আমাকে নিয়ে এলো।আমার বাম হাতটা ধরে আম্মা এ ঘরে, সে ঘরে অফিসারের রুমে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না।অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর জানালো এসপি সাহেবের সাথে দেখা হবে না।আপনারা ডিসি চলে যান।এখানে দেখা হবে না।তাচ্ছিল্য ভাবে তাড়িয়ে দেবার মতই।
আব্বাকে গ্রেফতার করে কোথায় রেখেছে, কোথায় আছে,কি করেছে কোন খোজ পাওয়া যাচ্ছে না।থানায় গেলে, জানায় এসপির কাছে যান।এসপি অফিস বলছে ডিসির কাছে যান।কেউ কোন তথ্য দিচ্ছেনা।একটা ভয়বহ গুমোট পরিস্থিতি।
আওয়ামীলীগের সকল নেতা কর্মী গ্রেফতার আতংকে পালিয়ে আছে।কাউকেই পাওয়া যাচ্ছেনা।
আমাকে নিয়ে আম্মা একা একাই এখানে সেখানে ঘুরছে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে।আজ কাল পরশু প্রতিদিনই……

আবার শুনা যাচ্ছে,আব্বকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, আবার শুনছি রাজশাহী আবার ঢাকায়।আবার শুনলাম ডিটেনশন দেয়া হয়েছে….

ডিটেনশন কি মা…?
আম্মাও ঠিকমত বলতে পারলো না।
পরে ডিসি অফিসের লোক বললো,তিন মাসের আগে কারো সাথে বন্দীর কোন সাক্ষাত হবে না।এটা সামরিক আদেশ।

বিরোধী দলে থেকে দলের নেতৃত্ব দেয়া,দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কত কষ্ট,ত্যাগ,নির্যাতনই না সহ্য করতে হয়েছে,সহ্য করেছে….
অন্তপ্রানেই যে ভালবাসে তার দলকে….

সব সময়ই,
“তার জন্য দল নয়
দলের জন্যই সে…….
এই নীতিতেই অবিচল অটুট থেকেছে…..

আজও কেন্দ্রীয় নেতাদের যখন বলি আমি বগুড়ার শহীদুল আলম দুদুর ছেলে, শ্রদ্ধা ভরে আব্বার কথা স্মরণ করে।বলে,লিকলিকে পাতলা আর সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা এক সদা হাস্যজ্বল সাদা মানুষ।
নেত্রী যাকে এতই ভালবাসে যে,বার বার উনাকেই এমপি’র নমিনেশন দেয়।

সিজোফেনিয়া বা হ্যালুসেনেশন বা বার্ধক্যজনিত কোন মানসিন কারণে আব্বার মাঝে গ্রেফতার ভীতিতে পুলিশ কে দেখে আর ভয় পায়।কতদিন যে আব্বার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়েছি। বলেছি ভয় নেই বাবা।
তুমি পুলিশকে ধমক দিবে.।
স্বান্তনা দিয়ে যাই বার বার……..

জানিনা আব্বার সে ভয়,আতংক দূর করতে পেরেছিলাম কিনা……!!!
তাইতো,
“এসপি” একটি পদের নাম হলেও আমার কাছে এটি একটি অনুভূতির নাম, যা ৩৬/৩৭ বছর আগে আব্বার মুখেই সেই ছোট্ট বেলায় প্রথম এ নাম শুনেছিলাম…

কতই না খুশি হতো আমাকে এভাবে দেখলে। মানুষের সেবা করার উপদেশ দিতো আর বলতো, বাবা শিমুল,”কাউকে কখনো কষ্ট দিওনা বাবা”

অনেক অনেক কিছুই মনে পড়ে আমার।
সবার মতো স্বাভাবিক নয়,সংগ্রাম আর রাজনৈতিক চক্রের চক্রাকারে বেড়ে উঠেছি।এসপি আর পুলিশের কতশত রাজনৈতিক ঘটনার শিকার আমরা আওয়ামীলীগ করায়….

ইতিহাস যে আমিই
আমিই যে এক ইতিহাস
আর,
আজ আমি সেই “এসপি সাহেব”
কিন্তু
আজ আব্বা নেই….

“কাউকে কখনো কষ্ট দিবো না আব্বা…..”

১৯.১২.২০২০

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত